ইয়াবা নামক ভয়ঙ্কর মাদক শুধু একজন মানুষের জীবনই নয়, ধ্বংস করে দেয় একটি পরিবার, একটি সমাজ এবং একটি দেশের ভবিষ্যৎ।
এর আসক্তি এমন একটি নেশা, যেটা ধীরে ধীরে একজন মানুষকে মনুষ্যত্বহীন করে তোলে।
তবে এই নেশা থেকে ফিরে আসা সম্ভব—শুধু প্রয়োজন আত্মজ্ঞান, ইচ্ছাশক্তি এবং একটি ইতিবাচক মানসিকতা।
নিচে ইয়াবা ছাড়ার ১২টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ও উপায় ব্যাখ্যা করা হলো,
যা একজন মাদকাসক্তকে উৎসাহ দিতে পারে এই নেশা থেকে মুক্তি পেতে।
১. নিজের আত্মসম্মান বাঁচানো:
মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলে।
ইয়াবার জন্য সে যেকোনো ব্যক্তির সাথে মিশে যেতে পারে, এমনকি অপরিচিত ও সন্দেহজনক চরিত্রের সঙ্গেও।
এই অবস্থায় আত্মমর্যাদাবোধ লোপ পায়, এবং এক সময় নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করে।
তাই আত্মসম্মান রক্ষার জন্য ইয়াবা পরিত্যাগ করা একান্ত জরুরি।
২. জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানো:
ইয়াবা সংগ্রহের জন্য একজন মাদকাসক্ত যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারে।
রাত-বিরাতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গমন, অপরিচিত ও অপরাধপ্রবণ লোকদের সংস্পর্শে আসা—এসব তার জীবনে নানা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পুলিশি ঝামেলা, মামলা-মোকদ্দমা ও কারাবাস জীবনের পুরো ভবিষ্যৎকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।
৩. স্বভাব নিচুস্তরে যাওয়া:
এই মাদকের জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে একজন মানুষ চুরি করে, মিথ্যে বলে, এমনকি পরিবারের মানুষদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।
ধীরে ধীরে সে মানবিকতা হারিয়ে পশুর মতো আচরণ করতে শুরু করে।
এই নিচুস্তরের জীবনে না পড়ে বরং নতুন করে জীবন শুরু করাই শ্রেয়।
৪. স্বাস্থ্য ঝুঁকি:
ইয়াবা সেবনের সময় সাধারণত কয়েন, বোতলের ঢাকনা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় এবং তা অনেকজন মিলে ব্যবহার করে।
এতে একে অপরের মুখের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা, এমনকি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
একজন সচেতন মানুষ এসব ঝুঁকি নেবে না।
৫. সামাজিক মর্যাদাহানি:
মাদক গ্রহণের জায়গাগুলো সাধারণত পরিত্যক্ত বাড়ি, ফাঁকা ঘর বা নির্জন স্থানে হয়।
প্রতিদিন এক জায়গায় গমন করার কারণে এলাকাবাসীর চোখে পড়ে যায়।
একজন শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে এই কাজ সামাজিকভাবে অসম্মানজনক এবং বিপজ্জনকও বটে।
৬. নিজের বুঝার দুর্বলতা:
মাদকাসক্ত ব্যক্তি মনে করে, তার আচরণ কেউ টের পাচ্ছে না।
অথচ বাস্তবতা ভিন্ন।
পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীরা তার পরিবর্তন বুঝতে পারে খুব সহজেই।
তবে অনেকে কিছু বলে না ভয় বা দুঃখে। এভাবেই সে নিজেকে প্রতারিত করে চলে।
৭. মস্তিষ্কের বিকৃতি:
নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ঘুম কমে যায়, এবং এতে মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায় না।
ফলে চিন্তাশক্তি হ্রাস পায়, সে অসংলগ্ন আচরণ করে, ও সহিংস হয়ে ওঠে।
এই ধরণের মানসিক অবস্থা এক সময় পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।
৮. প্রিয়জনের উপর নির্যাতন:
মাদকের জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই পরিবারের ওপর চড়াও হয়।
বাবা-মাকে মারধর করা, স্ত্রী বা সন্তানের ওপর নির্যাতন করা—এসব আজকাল দুঃখজনক হলেও কমন ঘটনা।
বাংলাদেশে এমন নজির রয়েছে, যেখানে সন্তান ইয়াবার জন্য নিজের মাকেও হত্যা করেছে। এসব ঘটনা শুধুমাত্র মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ফল।
৯. পিছিয়ে পড়া:
ইয়াবা সেবনের কারণে একটি ব্যক্তি জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে দেয়।
বছর চলে যায়, বয়স বাড়ে, কিন্তু ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে না।
একসময় নিজেকে অযোগ্য মনে হয়, এবং সব দোষ সে ভাগ্যকে দিতে শুরু করে। অথচ মূল দোষ ছিল নিজের সিদ্ধান্তে।
১০. নিজের মনকে ভুল বুঝানো:
মাদকসেবী প্রায়ই ভাবে, সে তো কারো ক্ষতি করছে না।
কিন্তু বাস্তবে, মিথ্যা বলার মাধ্যমে, পরিবারের সদস্যদের ধোকা দিয়ে, তাদের টাকার অপব্যবহার করে সে বিশাল ক্ষতি করে চলেছে।
নিজের মনকে সত্যিকারভাবে বুঝানোই এই সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ।
১১. ভেজাল মাদক:
বাংলাদেশে যেহেতু খাবারেই ভেজাল থাকে, সেখানে মাদকেও ভেজাল থাকা অস্বাভাবিক নয়।
অনেকেই উচ্চমূল্যে ইয়াবা কিনে তা খেয়ে শারীরিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে অর্থের অপচয়, শরীরের ক্ষতি এবং ভবিষ্যতের ধ্বংস—সব একসাথে হয়।
১২. বিকল্প নাই – এখনই ছাড়তে হবে:
ইয়াবার শেষ গন্তব্য জেল, হাসপাতাল বা কবর।
একবার মাদক ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে অনেকেই বলেন, “পরে ছাড়বো”।
কিন্তু পরে হয়তো সময় আর থাকে না।
অনেকে পরিবার হারিয়ে, জেল খেটে বা মারাত্মক অসুখে ভুগে তখন বুঝতে পারে যে, জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে।
অথচ সময় থাকতে সিদ্ধান্ত নিলে, নতুন করে জীবন গড়া সম্ভব।
ইয়াবা কখনোই বন্ধু নয়, এটি এক ঘাতক শত্রু। আত্মসম্মান, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, ভবিষ্যৎ—সবকিছু ধ্বংস করে দেয় এই নেশা।
তাই সময় থাকতে নিজেকে ভালোবাসতে হবে, এবং এই মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে আসতে হবে।
সমাজ, পরিবার এবং নিজের জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে
আজই ইয়াবা ছাড়বো, নতুন জীবন শুরু করবো।
-